পুরুষ, নারী ও শিশুদের ইহরাম বাঁধার পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা

হজ ও ওমরাহ পালনের জন্য প্রথমেই ইহরাম বাঁধতে হয় এবং ইহরাম বাঁধা হজ ও ওমরার জন্য প্রথম রুকন। হজ ফরজ এবং ওমরাহ একটি সুন্নাত এবাদত। এই দুইটি এবাদত এর পূর্বশর্ত হল ইহরাম বাঁধা। বলা হয় ইহরাম বাঁধা ফরজ। পুরুষ, নারী ও শিশুদের ইহরাম বাঁধায় কিছু ভিন্নতা র‍য়েছে। এখানে আমরা সেসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

ইহরাম কি?

ইহরাম শব্দটি এসেছে হারাম শব্দ থেকে । এর অর্থ হলো কোনো জিনিসকে নিজের ওপর হারাম বা নিষিদ্ধ করে নেওয়া। ওমরা পালনকারী ব্যক্তি ইহরাম বাঁধার মাধ্যমে নিজের ওপর স্ত্রী সহবাস, মাথার চুল, হাতের নখ, গোঁফ, বগল ও নাভির নিচের চুল ইত্যাদি কাটা, সুগন্ধি ব্যবহার, সেলাই করা কাপড় পরা এবং শিকার করাসহ কিছু বিষয়কে হারাম করে নেন। এজন্য এটিকে ইহরাম বলা হয়। আর হজ ও ওমরা পালনের নিয়তে যারা মক্কার উদ্দেশে গমন করেন, তাদের মিকাত (ইহরাম বাঁধার নির্ধারিত স্থান) অতিক্রম করার আগে ইহরামের কাপড় পরে নিতে হয়। ইহরাম না পরে মিকাত অতিক্রম করা তাদের জন্য জায়েজ নয়।

ইহরাম কেন বাঁধতে হয়?

নামাজের জন্য যেভাবে তাকবিরে তাহরিমা বাঁধা হয় ঠিক তেমনি হজের জন্য ইহরাম বাঁধা হয়। আর নামাজে যেমন তাকবিরে তাহরিমার মাধ্যমে স্বাভাবিক সময়ের অন্য হালাল ও বৈধ কাজগুলো নামাজি ব্যক্তির জন্য হারাম হয়ে যায়। ইহরামের মাধ্যমেও হজ ও ওমরা পালনকারী ব্যক্তির জন্য স্বাভাবিক অবস্থার অনেক হালাল কাজ হারাম হয়ে যায়। এ কারণেই হজ ও ওমরার জন্য ইহরামকে  ফরজ করা হয়েছে।

ইহরামের পোশাক

পুরুষদের জন্য সেলাইবিহীন দুই টুকরো সাদা কাপড় আর নারীদের জন্য স্বাচ্ছন্দ্যময় শালীন পোশাক পরিধান করাই হলো ইহরাম।

ইহরাম বাঁধার আগে যা করতে হয়

ইহরাম বাঁধার আগে গোঁফ, বগল ও নাভীর নিচের লোম পরিষ্কার করা, নখ কাটা, গোসল করে পাক সাফ হয়ে যাওয়া আবশ্যক। এমনকি ঋতুবর্তী মহিলাদেরও এ সময় গোসল করা মুস্তাহাব। সুগন্ধি ব্যবহার করাও মুস্তাহাব। তবে ইহরামের কাপড়ে আতর বা সুগন্ধি লাগাবে না। কেননা ইহরামের কাপড়ে এমন আতর বা সুগন্ধি লাগানো নিষেধ, যার ঘ্রাণ ইহরামের পরও বাকি থাকে। (রদ্দুল মুহতার, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৪৮৯; গুনইয়াতুন নাসিক, পৃষ্ঠা: ৭০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/২২২; মানাসিক মোল্লা আলী কারি, পৃষ্ঠা: ৯৮)

হযরত আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি নিজে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইহরাম বাঁধার আগে তাঁকে সুগন্ধি মাখিয়ে দিতাম। (বুখারি, মসুলিম, হিদায়া)। তবে ইহরাম বাঁধার পর সুগন্ধি ব্যবহার করা নিষেধ।ইহরাম বাঁধার আগে ভালোভাবে গোসল করে নিতে হবে, গোসল সম্ভব না হলে ওজু করতে হবে। 

ইহরাম বাঁধার নিয়ম

ইহরাম বাঁধার নিয়ম

মীকাতের জন্য নির্ধারিত স্থানে অথবা মীকাতের নির্ধারিত স্থানের আগেই ইহরামের কাপড় পরতে হয়। এসময় পুরুষেরা দু’টি নতুন বা পরিষ্কার সাদা চাদর নিবে। একটি লুঙ্গির মতো করে পরবে। অপরটি চাদর হিসাবে ব্যবহার করবে। পায়ের পাতার উপরের অংশ খোলা থাকে এমন জুতা বা স্যাণ্ডেল পরবে। নারীরা স্বাভাবিক কাপড় পরবে। তাদের জন্য ইহরাম অবস্থায় জুতা-মোজা পরতে পারবে। তবে নারীরা নেকাব ব্যবহার করবেন না।

আলী (রা.) নারীদের ইহরাম অবস্থায় নেকাব ব্যবহার করতে নিষেধ করতেন। তবে চেহারার উপর দিয়ে কাপড় ঝুলিয়ে দেওয়ার কথা বলতেন। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং: ১৪৫৩৯; আদিল্লাতুল হিজাব ৩২৯-৩৩৪; নাইলুল আওতার: ৫/৭১ মানাসিক: ১১৫, ফাতহুল বারি: ৩/৪৭৫; ইলামুল মুআককিয়িন: ১/১২২-১২৩) 

শিশুদের ইহরাম বাঁধার নিয়ম

বালক-বালিকা যদি বোধশক্তি সম্পন্ন না হয় তাহলে করণীয়:-

  • অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়ে যদি ভাল-মন্দ, পবিত্রতা-অপবিত্রতা সম্পর্কে জ্ঞান না থাকে তবে তাদের অভিভাবকগণকে তাদের পক্ষে ইহরাম, ওমরা ও হজের নিয়ত করে নিতে হবে।

  • ছেলে হলে তাদেরকে সেলাইবিহীন কাপড় পরিধান করাতে হবে ; আর মেয়ে হলে মেয়েদের নির্ধারিত পোশাক পরিধান করাতে হবে।

  •  তাদের পক্ষ থেকে অভিভাবককে তালবিয়া পড়তে হবে।

  • এ ভাবে বাচ্চা মুহরিম বলে গণ্য হবে।

  •  প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির জন্য ইহরাম অবস্থায় যা যা নিষিদ্ধ; বাচ্চার জন্যও তা নিষিদ্ধ।

বোধশক্তি সম্পন্ন বালক-বালিকার জন্য করণীয়:-

  • বালক-বালিকা যদি বোধ-শক্তি সম্পন্ন হয় অর্থাৎ পাক-পবিত্রতার জ্ঞান রাখে, তবে তারা অভিভাবকের অনুমতি নিয়ে ইহরাম বাঁধবে এবং তারা ইহরামের সময় ঐ নিয়মাবলীগুলো পালন করবে, যা বয়স্ক ব্যক্তিরা পালন করে থাকে। 

মাকরূহ ওয়াক্ত না হলে ইহরাম বাঁধার আগে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়বে। অতঃপর যে হজ আদায়ের ইচ্ছা সে অনুযায়ী নিয়ত করে তালবিয়া পাঠ করবে। নামাজের প্রথম রাকাআতে সুরা ফাতিহা পর সুরা কাফিরুন ও দ্বিতীয় রাকাআতে সুরা ইখলাস পড়া মুস্তাহাব। (নামাজের সময় মাথায় টুপি থাকবে, নামাজ শেষে নিয়তের আগেই টুপি খুলে ফেলা উচিত)।

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) হজের উদ্দেশ্যে মদিনা থেকে রওনা হয়ে জুলহুলাইফাতে পৌঁছলেন এবং দুই রাকাত নামাজ পড়লেন। অতঃপর জুলহুলাইফার নিকট যখন উটনী তাকে নিয়ে উঠে দাঁড়াল তখন তিনি তালবিয়া পাঠ করলেন...। (মুসলিম: ১/৩৭৬)

ইহরামের নিয়ত করা

ইহরামের কাপড় পরিধানের পর ইহরামের নিয়ত করতে হবে। যদি ওমরা জন্য ইহরাম হয় তাহলে বলবে- ‘লাব্বাইক ওমরাতান’ আর যদি ইহরাম হজের জন্য হয় তাহলে বলবে- ‘লাব্বাইক হাজ্জান’।

অতঃপর হজ বা ওমরা সহজে সম্পাদনের জন্য ইমাম কুদুরি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এ দোয়াটি পড়তে বলেন- ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি উরিদুল উমরাতা/হাজ্জা ফাইয়াসসিরহু লি ওয়া তাকাব্বালহু মিন্নি’

অর্থ : হে আল্লাহ! আমি ওমরার/হজের ইচ্ছা করছি; আপনি আমার জন্য তা সহজ করে দিন এবং আমার পক্ষ থেকে তা কবুল করুন।’

ইহরাম বাঁধা অবস্থায় নিষিদ্ধ কাজ

১.পুরুষের জন্য যেকোনো ধরণের সেলাইকৃত কাপড় পরা নিষিদ্ধ।

আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করল, মুহরিম (ইহরাম পরিহিত) কী কী কাপড় পরতে পারবে? তখন তিনি বলেন, জামা-পাগড়ি, পাজামা, টুপি ও মোজা পরবে না। তবে জুতা না থাকলে চামড়ার মোজা গিরার নিচ পর্যন্ত কেটে পরতে পারবে। তোমরা এমন কোনো কাপড় পরিধান করো না যাতে ‘জাফরান’ বা ‘ওয়ারছ’ লেগেছে।  (মুসলিম, খণ্ড: ০১, হাদিস নং: ৩৭২)

২.ইহরাম বাঁধা অবস্থায় স্বামী-স্ত্রীর বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন বা স্ত্রীর সামনে এ সংক্রান্ত কোনো কথা বলা বা কাজ করা নিষিদ্ধ। 

৩.বন্য পশু শিকার বা শিকারীকে সহযোগিতা করা নিষিদ্ধ। 

কোরআন মজিদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, তোমাদের ওপর প্রাণী শিকার করা হারাম করা হয়েছে, যে পর্যন্ত ইহরাম অবস্থায় থাকো। (সুরা মায়িদাহ, আয়াত: ৯৬)

৪.নখ কাটা, শরীরের কোনো স্থানের চুল, পশম কাটা-উপড়ানো নিষেধ।

আতা, তাউস ও মুজাহিদ রাহ. প্রমুখ বিখ্যাত তাবেয়িগণ বলেন, ‘মুহরিম তার বগলের নিচের পশম উপড়ালে বা নখ কাটলে তার উপর ফিদয়া দেওয়া ওয়াজিব হবে। ’ (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং: ১৩৬০৪) 

৫.আতর বা সুগন্ধি, তেল, সাবান, স্নো কিংবা যেকোন ধরণের সাজ-সজ্জা মূলক সামগ্রী ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। 

ইয়ালা ইবনে উমাইয়্যা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুলে (সা.) যখন জিঈররানা নামক স্থানে অবতরণ করলেন, তখন এক ব্যক্তি তার কাছে এলেন, লোকটির পরনে জাফরান মিশ্রিত এক ধরনের সুগন্ধিযুক্ত জুব্বা ছিল...। রাসুল (সা.) তাকে বললেন, সুগন্ধির চিহ্ন দূর করো এবং জুব্বা খুলে ফেল। ’ (মুসলিম, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৩৭৩)

বিখ্যাত তাবেয়ি আতা (রহ.) বলেন, ‘ইহরাম গ্রহণকারী তার শরীরে কিংবা কাপড়ে সুগন্ধিযুক্ত তেল লাগালে তার উপর কাফফারা ওয়াজিব হবে। ’ (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং: ১৪৮৩৩)

৬.ঝগড়া বিবাদ করা।

ইসলাম শান্তির ধর্ম। ঝগড়া-বিবাদ করা সব সময়ের জন্যি নিষিদ্ধ।ইহরাম অবস্থায় আরো কঠোরভাবে এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। 

কোরআন কারিমে আল্লাহ বলেন, ‘হজের মাসগুলি সুবিদিত। অতএব যে ব্যক্তি এ মাসগুলিতে হজ করা স্থির করে, অতঃপর হজে না অশ্লীলতা আছে এবং না অসৎ কাজ এবং না ঝগড়া-বিবাদ। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৯৭)

৭. যেকোনো কীটপতঙ্গ হত্যা করা নিষিদ্ধ। উকুন, মশা ইত্যাদি না মেরে তাড়িয়ে দেওয়াই বিধান। কাপড় বা শরীরের উকূন মারা নিষিদ্ধ। (আদ্দুররুল মুখতার: ২/৪৮৬-৪৯০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২২৪; মানাসিক ১১৭-১২০; গুনইয়াতুন নাসিক: ৮৫) 

তালবিয়া পাঠের নিয়ম

ইহরাম বাঁধা থেকে তাওয়াফ শুরু পর্যন্ত তালবিয়া পাঠের বিধান। তালবিয়া হচ্ছে : ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক।’ অর্থ : আমি আপনার ডাকে সাড়া দিয়েছি, হে আল্লাহ! আমি আপনার ডাকে সাড়া দিয়েছি। আমি আাপনার ডাকে সাড়া দিয়েছি, আপনার কোন শরীক নেই, আমি আপনার ডাকে সাড়া দিয়েছি। নিশ্চয়ই সমস্ত প্রশংসা, নে’মত এবং সাম্রাজ্য আপনারই। আপনার কোনো শরিক নেই। (বুখারি, হাদিস : ১৫৪৯; মুসলিম, হাদিস : ২৮১১)

পুরূষদের জন্য তালবিয়া পাঠের বিধান হল উচ্চস্বরে। আর নারীরা পাঠ করবেন মৃদুস্বরে।

তবে উভয়ের জন্যই তালবিয়া পাঠ অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে।

আরও পড়ুন: ওমরাহ পালনের সময় যে সব মাসায়েল জানা প্রয়োজন

পরিশেষ 

আমরা এই পোষ্টে পুরুষ, নারী ও শিশুদের ইহরাম বাঁধার নিয়ম,প্রস্তুতি ও ইহরাম বাঁধার পর তালবিয়া পাঠের পদ্ধতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করেছি। ইহরাম বাঁধার পর নিষিদ্ধ কাজগুলোর ওপর আলোকপাত করার চেষ্টা করেছি। আশাকরি পাঠক এই পোস্টের মাধ্যমে ইহরাম সম্পর্কে সবকিছু জানতে, বুঝতে ও আমল করতে পারবেন। আপনাদের যে কোন মতামত বা জিজ্ঞাসা কমেন্টের মাধ্যমে জানাতে পারেন অথবা ইমেইল করতে পারেন এই ঠিকানায়: itsholidaysbd@gmail.com

Social Share

Popular Tags

luxury booking luxury hajj luxury umrah Sylhet TourB2B Agents in BangladeshBangladeshBangladesh ToursBangladesh's leading Destination Management Company (DMC)Bangladeshi Tour PackageBarisal ToursBest Time to Experience Turkey's BeautyBest Time To Visit Iceland For Cheapbest tour plannerblogbookingChattogram TourCox's Bazar ToursDhakaDhaka ToursDiscover BangladeshEuropeeuropetoureuropetripeuropevisaHajjHajjumrahholidaysholidaytourshotelhotelsHotels with ITS Holidays Ltd - Best Online Hotel BookingHow Much Does It Cost To Go To Indonesia From BangladeshInternational-Tour-Packagesislamitsholidaysltd.comjourneyKhulna toursluxury bookingluxury hajjluxury hotelsluxury umrahmadinahMakkahMaldives Trip CostmaldivestourMymensingh tourMymensingh tour packagesonlineonlinetoursonlinetravelOnlneRajshahi ToursRangpur ToursresortresortbookingresortsschengenSingaproeSundarbansSylhet TourSylhet ToursTentative Travel Air Fare All Kinds of TravelersThe Surprising Benefits of Educational Tours You Never KnewTourTour Package OperatorTour-packagesTourism management companytourofeuropetourstravelTravel and Tourism ManagementTravel and Tourism Management CompanyTravel GuidetravelstraveltojapantriptriptosingaporeUmrahUmrah-2024Umrah-2025Umrah-2026umrahbdUMRAHBOOKINGumrahdubaiumrahfrombangladeshumrahhajjumrahofficeumrahpackagesUmrahservicesuxury umrahVisaVisa-servicesVisitVisit to SylhetVisitBangladeshWhat Is The Difference Between Tour And Travelworldটাঙ্গুয়ার-হাওর-ট্যুর