আমাদের সমাজে ওমরাহের উপকারীতাগুলো নিয়ে ততটা আলোচনা করা হয় না যতটা হজের উপকারীতা নিয়ে করা হয়। ওমরাহ সুন্নাত এবাদত হওয়ার কারনে ওমরাহ নিয়ে চর্চাও হয় কম। ওম্রাহকে হজে আসগার বা ছোট হজও বলা হয়য়। ওমরাহ সংক্ষিপ্ত কিন্তু একটি সুন্নাহ এবাদত। হজের সময় ব্যতীত যেকোনো সময় ওমরাহ পালন করা যায়। এটি মূলত মক্কা তথা কাবাঘর কেন্দ্রীক এবাদত যেটি ওমরাহ কারিগণ তাওয়াফ এবং সাঈ করার মাধ্যমে সম্পন্ন করে থাকেন। ওমরাহ পালনের গভীর আধ্যাত্মিক গুরুত্ব রয়েছে। যারা ওমরাহ পালন করেন তাদের বলা হয় মুতামির ।
আমরা জানি ওমরাহ পালনের মাধ্যমে মুতামিরগণ গভীর আত্মার পরিশুদ্ধি লাভ করেন । তবে এছাড়াও ওমরাহর আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ উপকারিতা রয়েছে যেগুলি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক ভাবে প্রভাব বিস্তার করে। হজ পালনের মতই ওমরাহ পালনের জন্যও কোরআন ও হাদিসে মুসলিমদের জন্য নির্দেশ এসেছে।
আল্লাহ কোরআনে বলেন, “আর তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ্জ্ব ওমরাহ পরিপূর্ণ ভাবে পালন কর… “ (আল কোরআন ২:১৯৬)।
আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত-রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘এক ওমরাহ অপর ওমরাহ পর্যন্ত সংঘটিত গুনাহগুলোর কাফফারাস্বরূপ। কবুল হজের প্রতিদান জান্নাত ছাড়া আর কিছুই নেই।’ (ইবনে মাজাহ : ২৮৮৮)
একটি হাদিসে ওমরাহ পালনকারিদের আল্লাহর ঘরে মেহমান বলা হয়েছে।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত-রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর পথে যুদ্ধে বিজয়ী, হজকারী ও ওমরাহকারী আল্লাহর মেহমান বা প্রতিনিধি। আল্লাহ তাদের আহ্বান করেছেন, তারা তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছেন। আর তারা তাঁর কাছে যা চেয়েছেন এবং তিনি তাদের দিয়েছেন’ (ইবনে মাজাহ : ২৮৯৩)।
নবী মুহাম্মদ (সা) অন্য একটি হাদিসে এ বিষয়ে আরো বলেছেন,
‘হজ ও ওমরাহ পালনকারীরা আল্লাহর মেহমান বা প্রতিনিধি। তারা আল্লাহকে ডাকলে তিনি তাদের ডাকে সাড়া দেন। তারা তাঁর কাছে মাগফিরাত কামনা করলে তিনি তাদের ক্ষমা করে দেন।’ (ইবনে মাজাহ : ২৮৯২)।
আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) সূত্রে বর্ণিত; তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা হজ ও ওমরাহ আদায় করো। কেননা, হজ ও ওমরাহ দারিদ্র্য বিমোচন ও গোনাহ দূর করে দেয় ঠিক সেভাবে, যেভাবে হাঁপরের আগুন লোহা, সোনা ও রুপা থেকে ময়লা দূর করে দেয়।’ (তিরমিজি: ৮১০)।
সুতরাং আমরা দেখতে পাচ্ছি ধর্মীয় দৃষ্টিতে ওমরাহর গুরুত্ব ও উপকারীতা অপরিসীম। তবে এছাড়া ব্যক্তিগত জীবনেও এর ব্যাপক প্রভাব রয়েছে।
এবারে আপনাদের সাথে ওমরাহর ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিকতার সাথে ব্যক্তিগত ও সামাজিক কিছু উপকারীতা ও প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।
ওমরাহ পালনের একটি বড় অংশ হলো ভ্রমণ, শৃঙ্খলাবদ্ধ, নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন ইত্যাদি । এগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয় একাগ্র হয়ে এবাদত-বন্দেগী এবং ধর্মীয় বিধানগুলোও মেনে চলা। ব্যক্তিগত জীবনের একাগ্রতা ও ধর্মীয় জীবনের নিষ্ঠাপূর্ণ এবাদত বা আল্লাহর প্রতি আনুগত্য মানুষের শরীর ও মনকে গভীরভাবে নাড়া দেয় । পারিপার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তন এবং আধ্যাত্মিকতার মেলবন্ধনে শরীর ও মন দুটিই পরিশুদ্ধি লাভ করে। যার ফলে আমরা দুনিয়াবি নানান চাপ থেকে মুক্ত হয়ে একটি নির্মল মন লাভ করতে পারি।
বর্তমান যুগে আমরা লক্ষ করছি আমাদের পারিবার গুলো ভেঙ্গে যাচ্ছে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে নানান কারণে দূরত্ব অনেক বেড়ে যাচ্ছে। ওমরাহ পালন করতে যাওয়ার মাধ্যমে আমরা এই ভয়ঙ্কর সমস্যার একটি সুন্দর সমাধান করতে পারি। পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ওমরাহ করতে যাওয়ার ফলে সবাই একসাথে পুরোটা সময় মক্কা-মদীনার একটি আধ্যাত্মিক পরিবেশে থাকার সুযোগ পায়। আত্মার বন্ধন সবাই নতুন করে উপলব্ধি করতে পারে। পাশাপাশি একসাথে যাওয়া, থাকা, খাওয়া সহ ওমরাহর কাজগুলো যেমন তাওয়াফ, সাঈ ইত্যাদি একসাথে করার মাধ্যমে একে অপরের প্রতি দায়িত্ববোধ ও মমত্ববোধ নতুন করে জেগে ওঠে। পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় করার ক্ষেত্রে যা অসাধারণভাবে কাজ করে।
ওমরাহ পালন করতে যাওয়া আমাদের ধর্মীয় জীবনে বিপুল অবদান তো রাখেই সাথে সাথে ব্যক্তিগত পর্যায়েও আমাদেরকে অনেক ভাবে সহায়তা করে থাকে। ওমরাহর পুরো সময়টাতে রুটিন মাফিক জীবনযাপন এবং এবাদত এর মাধ্যমে আমরা একটি শৃঙ্খলাবদ্ধ এবং নিয়ন্ত্রিত জীবনের জন্য প্রশিক্ষণ নিতে পারি। ওমরাহতে যাওয়ার প্রস্তুতি থেকে শুরু করে সাঈ করার পর মাথা মুণ্ডন পর্যন্ত পুরো প্রক্রিয়াটিই এমন যেখানে সকল বিলাসিতা ত্যাগ করে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে আল্লাহ পথে সঁপে দেওয়ার জন্য নিজেকে তৈরী করা হয়। এর মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণ, চিন্তাশীলতা ও ভোগ-বিলাস মুক্ত জীবনের চেতনা আমরা ধারণ করা যায়।
আমরা জানি পবীত্র নগরী এবং নবী-রাসুলের পূণ্যভুমি। মক্কা ও মদীনায় ক্রমাগত মহান আল্লাহর রহমত নাযিল হতে থাকে। যার মধ্যে সমস্ত মানব জাতির জন্য কল্যাণ নিহিত থাকে। পুরো পরিবেশ থাকে নির্মল আধ্যাত্মিকতায় পরিপূর্ণ। হজ এবং ওমরাহ পালনকারিরা প্রায়শই গভীর এই আধ্যাত্মিকতার স্বাদ পান এবং নিজেকে মূল্যায়ন করতে পারেন। নিজের জীবনে উপোলব্ধি করতে পারেন।
দৈনন্দিন জীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে জর্জরিত হয় আমাদের জীবন। নফসের ধোঁকায় পরে অজান্তেই রূহের ক্ষতিসাধন করি আমরা। ওমরাহ পালন করতে যাওয়ার মাধ্যমে প্রতিদিনের সেই একঘেঁয়ে জীবনটাকে আমরা পেছেনে ফেলে যাই। পুরো সময় আল্লাহর ধ্যানে, আল্লাহর পথে মশগুল থাকার চেষ্টা করি। সাধারণ প্রাকৃতিক কাজ ব্যাতিত আল্লাহ জিকিরে মগ্ন থাকার চেষ্টা করি। যাতে মন হয় শান্ত, আত্মা হয় পরিশুদ্ধ।
আমরা জানি এবাদতের মধ্যে একটি ব্যতিক্রমী এবাদত হল দান। মক্কা-মদীনায় দান নিসন্দেহে আরো বেশি ফজিলতপূর্ণ। ওমরাহর পালন করতে যাঁরা যান তাঁরা মক্কা ও মদীনায় এবং শহর গুলোর আশেপাশের সুবিধা বঞ্চিত মানুষের মাঝে দান সদকা করে দো জাহানের অশেষ নেকি হাসিল করেন।
ওমরাহ পালনের জন্য বেশ কায়িক বা শারিরীক পরিশ্রম করার প্রয়োজনীয়তা থাকে যেমন দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা, হাঁটা ইত্যাদি। যেগুলো শরীরের সহনশীলতা, হৃদপিণ্ডের কার্য্যকারিতা এবং সামগ্রিক স্বাস্থের জন্য ব্যাপক উপকারী।
যেহেতু হজ এবং ওমরাহ পালনের জন্য সারা দুনিয়াথেকে মুসলিমরা আসেন সেহেতু তাদের একে অপরের সাথে সৌহার্দ্য আদান প্রদান হয় এবং নেটওয়ার্ক তৈরী হয় যার মাধ্যমে পুরো মুসলিম উম্মাহ উপকৃত হতে পারে। উন্মোচিত হয় সৌজন্যতা ও সম্প্রীতির নতুন দিগন্ত।
ওমরাহ পালনে বেশ কিছু কাজ রয়েছে যেগুলোর জন্য ধৈর্য্য ধারণ করে আন্তরিকতার সহিত অপেক্ষা করতে হয়। যেখানে তাড়াহুড়ো করার কোন সুযোগ নেই যা আমাদের আন্তরিক ও ধৈর্য্যশীল হতে শেখায়। আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য যেটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
আল্লাহ কোরআনে বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ! ধৈয্য ও সালাতের মাধ্যমে তোমরা সাহায্য প্রার্থনা করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সঙ্গে আছেন।’ (সূরা: বাকারা, আয়াত : ১৫৩)।
ওমরাহ ভিত্তিক বিভিন্ন প্রদর্শনী আয়োজিত হয়। যেখানে প্রদর্শিত বিভিন্ন শিল্পকর্ম ও পাণ্ডূলিপি
দর্শনের মাধ্যমে দর্শনার্থীরা ওমরাহর ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং বিবর্তনের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারেন। প্রদর্শনীতে আরো থাকে ওমরাহর স্থানে সম্পর্কযুক্ত নানান বিবরণ ও ঐতিহাসিক স্থানের মডেল।
আমরা বলতে পারি ওমরাহ পালন শুধু মাত্র আধ্যাত্মিকতা ও এবাদতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। আমাদের জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন শারীরিক, মানসিক সকল ক্ষেত্রেই ওমরাহর উপকারীতা আমরা দেখতে পাই। যখন ধর্মপ্রাণ মুসলিমরা ওমরাহ পালনের জন্য যান তখন তাঁরা একটি পরিবর্তিত হওয়ার মানসিকতা নিয়েই সেখানে যান। তাঁদের হৃদয়ে ওমরাহ পালনের অভিজ্ঞতা প্রবলভাবে প্রভাব বিস্তার করে।
জীবনের সকল ক্ষেত্রেই আমৃত্যু আমরা এর উপকারীতা পেতে থাকি। এই অভিজ্ঞতা ব্যক্তিত্বকে সমৃদ্ধ করে, আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস গভীরতর করে এবং সর্বোপরি মহান আল্লাহর রহমতের দিকে এগিয়ে যেতে আমাদের সাহায্য করে।