ওমরাহ পালনের নিয়ম ও শরিয়ত সম্মত পদ্ধতি নিয়ে আমাদের মনে থাকে নানান জিজ্ঞাসা। সঠিক মাসলা-মাসায়েল নিয়ে অনেক সময় আমাদের মধ্যে তৈরি হয় অস্পষ্টতা। আমরা কোরআন হাদিসের আলোকে ওমরাহর পালনের নিয়মগুলি সহজভাবে উপস্থাপনের চেষ্টা করব।
ওমরা হজ্জ সদৃশ্য একটি সুন্নাহ এবাদত। আল্লাহ কোরআনে বলেন, “আর তোমরা হজ ও ওমরাহ পূর্ণ কর আল্লাহর উদ্দেশ্যে…।” সুরা বাকারা: আয়াত ১৯৬।
জাবির ইবনে আব্দুল্লাহ রা: থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা: হজ করেছেন তিনবার, দুইবার হিজরতের আগে এবং একবার হিজরতের পর। তিনি এই (শেষোক্ত) হজের সাথে ওমরাহও করেছেন।......(তিরমিজি, হাদিস : ৮১৫)
হজরত কাতাদা রহ: থেকে বর্ণিত একটি রেওয়ায়েত থেকে জানা যায়, তিনি বলেন, আমি আনাস (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর রাসুল (সা.) কতবার ওমরাহ আদায় করেছেন? তিনি বলেন, চারবার। তন্মধ্যে হুদায়বিয়ার ওমরাহ জুলকাদা মাসে যখন মুশরিকরা তাঁকে মক্কায় প্রবেশ করতে বাধা দিয়েছিল। পরবর্তী বছরের জুলকাদা মাসের ওমরাহ, যখন মুশরিকদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল, জিরানার ওমরাহ, যেখানে নবী (সা.) গনিমতের মাল, সম্ভবত হুনায়নের যুদ্ধে বণ্টন করেন। আমি বললাম, আল্লাহর রাসুল (সা.) কতবার হজ করেছেন? তিনি বলেন, ‘একবার’। (বুখারি, হাদিস : ১৭৭৮)
ওমরাহ এর অর্থ মূলত জিয়ারত, সাক্ষাৎ বা পরিদর্শন। আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের আশায় বাইতুল্লাহ বা কাবাঘর জিয়ারত ও সাঈ করাই হল ওমরাহ। হজ্জের সাথে ওমরাহ পালনের কিছু পার্থক্য রয়েছে। সহজ ভাষায় হজ্জের সময় অর্থাৎ ৮ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত পাঁচ দিন ব্যাতিত বছরের যেকোন সময় ইহরাম পরা অবস্থায় কাবাঘর তাওয়াফ এবং সাফা-মারওয়া সাঈ করাই মূলত ওমরাহ পালন। যিনি ওমরাহ পালন করেন তাঁকে বলা হয় মুতামির।
ওমরাহ পালনে করনীয় নিয়ম গুলোকে আমরা প্রধানত দুইভাগে ভাগ করতে পারি।
ফরজ এবং ওয়াজিব।
১. ওমরাহের ফরজ দুটি।
ইহরাম বাঁধা।
কাবাঘর তাওয়াফ করা।
২. ওমরাহের ওয়াজিবও দুটি।
সাফা-মারওয়া সাঈ করা।
মাথার মুণ্ডন বা ছোট করা।
আমরা জানি ইসলাম একটি পূর্নাঙ্গ জীবন বিধান। সকল এবাদত ও দৈনন্দিন কার্যসমাধা সকল নিয়মাবলি সকলের জন্য উন্মুক্ত করা রয়েছে।
আমরা এ পর্যায়ে ওমরাহ পালনের সকল বিধান নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করছি।
ইহরাম শব্দটি এসেছে হারাম শব্দ থেকে । এর অর্থ হলো কোনো জিনিসকে নিজের ওপর হারাম বা নিষিদ্ধ করে নেওয়া। ওমরা পালনকারী ব্যক্তি ইহরাম বাঁধার মাধ্যমে নিজের ওপর স্ত্রী সহবাস, মাথার চুল, হাতের নখ, গোঁফ, বগল ও নাভির নিচের চুল ইত্যাদি কাটা, সুগন্ধি ব্যবহার, সেলাই করা কাপড় পরা এবং শিকার করাসহ কিছু বিষয়কে হারাম করে নেন। এজন্য এটিকে ইহরাম বলা হয়। আর হজ ও ওমরা পালনের নিয়তে যারা মক্কার উদ্দেশে গমন করেন, তাদের মিকাত (ইহরাম বাঁধার নির্ধারিত স্থান) অতিক্রম করার আগে ইহরামের কাপড় পরে নিতে হয়। ইহরাম না পরে মিকাত অতিক্রম করা তাদের জন্য জায়েজ নয়।
নামাজের জন্য যেভাবে তাকবিরে তাহরিমা বাঁধা হয় ঠিক তেমনি হজের জন্য ইহরাম বাঁধা হয়। আর নামাজে যেমন তাকবিরে তাহরিমার মাধ্যমে স্বাভাবিক সময়ের অন্য হালাল ও বৈধ কাজগুলো নামাজি ব্যক্তির জন্য হারাম হয়ে যায়। ইহরামের মাধ্যমেও হজ ও ওমরা পালনকারী ব্যক্তির জন্য স্বাভাবিক অবস্থার অনেক হালাল কাজ হারাম হয়ে যায়। এ কারণেই হজ ও ওমরার জন্য ইহরামকে ফরজ করা হয়েছে।
ইহরাম বাঁধার আগে গোঁফ, বগল ও নাভীর নিচের লোম পরিষ্কার করা, নখ কাটা, গোসল করে পাক সাফ হয়ে যাওয়া আবশ্যক। এমনকি ঋতুবর্তী মহিলাদেরও এ সময় গোসল করা মুস্তাহাব। সুগন্ধি ব্যবহার করাও মুস্তাহাব। তবে ইহরামের কাপড়ে আতর বা সুগন্ধি লাগাবে না। কেননা ইহরামের কাপড়ে এমন আতর বা সুগন্ধি লাগানো নিষেধ, যার ঘ্রাণ ইহরামের পরও বাকি থাকে। (রদ্দুল মুহতার, খণ্ড: ২, পৃষ্ঠা: ৪৮৯; গুনইয়াতুন নাসিক, পৃষ্ঠা: ৭০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া: ১/২২২; মানাসিক মোল্লা আলী কারি, পৃষ্ঠা: ৯৮)
হযরত আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমি নিজে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ইহরাম বাঁধার আগে তাঁকে সুগন্ধি মাখিয়ে দিতাম। (বুখারি, মসুলিম, হিদায়া)। তবে ইহরাম বাঁধার পর সুগন্ধি ব্যবহার করা নিষেধ।ইহরাম বাঁধার আগে ভালোভাবে গোসল করে নিতে হবে, গোসল সম্ভব না হলে ওজু করতে হবে।
মীকাতের জন্য নির্ধারিত স্থানে অথবা মীকাতের নির্ধারিত স্থানের আগেই ইহরামের কাপড় পরতে হয়। এসময় পুরুষেরা দু’টি নতুন বা পরিষ্কার সাদা চাদর নিবে। একটি লুঙ্গির মতো করে পরবে। অপরটি চাদর হিসাবে ব্যবহার করবে। পায়ের পাতার উপরের অংশ খোলা থাকে এমন জুতা বা স্যাণ্ডেল পরবে। নারীরা স্বাভাবিক কাপড় পরবে। তাদের জন্য ইহরাম অবস্থায় জুতা-মোজা পরতে পারবে। তবে নারীরা নেকাব ব্যবহার করবেন না।
আলী (রা.) নারীদের ইহরাম অবস্থায় নেকাব ব্যবহার করতে নিষেধ করতেন। তবে চেহারার উপর দিয়ে কাপড় ঝুলিয়ে দেওয়ার কথা বলতেন। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং: ১৪৫৩৯; আদিল্লাতুল হিজাব ৩২৯-৩৩৪; নাইলুল আওতার: ৫/৭১ মানাসিক: ১১৫, ফাতহুল বারি: ৩/৪৭৫; ইলামুল মুআককিয়িন: ১/১২২-১২৩)
বালক-বালিকা যদি বোধশক্তি সম্পন্ন না হয় তাহলে করণীয়:-
অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছেলে-মেয়ে যদি ভাল-মন্দ, পবিত্রতা-অপবিত্রতা সম্পর্কে জ্ঞান না থাকে তবে তাদের অভিভাবকগণকে তাদের পক্ষে ইহরাম, ওমরা ও হজের নিয়ত করে নিতে হবে।
ছেলে হলে তাদেরকে সেলাইবিহীন কাপড় পরিধান করাতে হবে ; আর মেয়ে হলে মেয়েদের নির্ধারিত পোশাক পরিধান করাতে হবে।
তাদের পক্ষ থেকে অভিভাবককে তালবিয়া পড়তে হবে।
এ ভাবে বাচ্চা মুহরিম বলে গণ্য হবে।
প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যক্তির জন্য ইহরাম অবস্থায় যা যা নিষিদ্ধ; বাচ্চার জন্যও তা নিষিদ্ধ।
বোধশক্তি সম্পন্ন বালক-বালিকার জন্য করণীয়:-
বালক-বালিকা যদি বোধ-শক্তি সম্পন্ন হয় অর্থাৎ পাক-পবিত্রতার জ্ঞান রাখে, তবে তারা অভিভাবকের অনুমতি নিয়ে ইহরাম বাঁধবে এবং তারা ইহরামের সময় ঐ নিয়মাবলীগুলো পালন করবে, যা বয়স্ক ব্যক্তিরা পালন করে থাকে।
মাকরূহ ওয়াক্ত না হলে ইহরাম বাঁধার আগে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়বে। অতঃপর যে হজ আদায়ের ইচ্ছা সে অনুযায়ী নিয়ত করে তালবিয়া পাঠ করবে। নামাজের প্রথম রাকাআতে সুরা ফাতিহা পর সুরা কাফিরুন ও দ্বিতীয় রাকাআতে সুরা ইখলাস পড়া মুস্তাহাব। (নামাজের সময় মাথায় টুপি থাকবে, নামাজ শেষে নিয়তের আগেই টুপি খুলে ফেলা উচিত)।
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) হজের উদ্দেশ্যে মদিনা থেকে রওনা হয়ে জুলহুলাইফাতে পৌঁছলেন এবং দুই রাকাত নামাজ পড়লেন। অতঃপর জুলহুলাইফার নিকট যখন উটনী তাকে নিয়ে উঠে দাঁড়াল তখন তিনি তালবিয়া পাঠ করলেন...। (মুসলিম: ১/৩৭৬)
ইহরামের কাপড় পরিধানের পর ইহরামের নিয়ত করতে হবে। যদি ওমরা জন্য ইহরাম হয় তাহলে বলবে- ‘লাব্বাইক ওমরাতান’ আর যদি ইহরাম হজের জন্য হয় তাহলে বলবে- ‘লাব্বাইক হাজ্জান’
অতঃপর হজ বা ওমরা সহজে সম্পাদনের জন্য ইমাম কুদুরি রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এ দোয়াটি পড়তে বলেন- ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি উরিদুল উমরাতা/হাজ্জা ফাইয়াসসিরহু লি ওয়া তাকাব্বালহু মিন্নি’
অর্থ : হে আল্লাহ! আমি ওমরার/হজের ইচ্ছা করছি; আপনি আমার জন্য তা সহজ করে দিন এবং আমার পক্ষ থেকে তা কবুল করুন।’
ইহরাম পরিধান করার জন্য ৫টি নির্দিষ্ট স্থান রয়েছে। এগুলোকে বলা হয় মীকাত।
ইহরামের নিয়তে এই দোয়া পড়া যায় : ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি উরিদুল ওমরতা ফা-ইয়াসসিরহু লি ওয়া তাকাব্বালহু মিন্নি।’ অর্থ : হে আল্লাহ! আমি ওমরাহর ইচ্ছা করছি, আপনি আমার জন্য তা সহজ করে দিন এবং আমার পক্ষ থেকে তা কবুল করুন।’
এরপর বলতে হবে : ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা ওমরতান/ওমরাহ (অর্থ : হে আল্লাহ! ওমরাহকারী হিসেবে আপনার দরবারে হাজির)।
তালবিয়া পাঠ করতে হবে অনবরত।
পুরুষদের জন্য সেলাইবিহীন দুই টুকরো সাদা কাপড় আর নারীদের জন্য স্বাচ্ছন্দ্যময় শালীন পোশাক পরিধান করাই হলো ইহরাম।
পুরুষরা ইহরামের সময় সেলাই করা কাপড় খুলে সেলাইবিহীন কাপড় পরিধান করবে। (বুখারি, হাদিস নং : ১৭০৭)
আর নারীদের জন্য ইহরাম হল স্বাভাবিক পোশাক।
মা আয়েশা (রা.) বলেন, ‘নারীরা ইহরাম অবস্থায় নিজ অভিরুচি মাফিক পোশাক পরতে পারবেন। ’ (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং: ১৪৪৩)
তবে নারীরা নেকাব ব্যবহার করবেন না।
আলী (রা.) নারীদের ইহরাম অবস্থায় নেকাব ব্যবহার করতে নিষেধ করতেন। তবে চেহারার উপর দিয়ে কাপড় ঝুলিয়ে দেওয়ার কথা বলতেন। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং: ১৪৫৩৯; আদিল্লাতুল হিজাব ৩২৯-৩৩৪; নাইলুল আওতার: ৫/৭১ মানাসিক: ১১৫, ফাতহুল বারি: ৩/৪৭৫; ইলামুল মুআককিয়িন: ১/১২২-১২৩)
ইহরাম পরিধানের পূর্বে কিছু প্রয়োজনীয় পবিত্রতা অর্জন করা, হাত ও পায়ের নখ কাটা, গোঁফ কাটা,শরীরের অপ্রয়োজনীয় লোম পরিষ্কার করা।ইহরাম বাঁধার এর পূর্বে গোছল করা সুন্নাহ। শরীরে বা দাড়িতে সুগন্ধি লাগানো মুস্তাহাব।
আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.) বলেন, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করল, মুহরিম (ইহরাম পরিহিত) কী কী কাপড় পরতে পারবে? তখন তিনি বলেন, জামা-পাগড়ি, পাজামা, টুপি ও মোজা পরবে না। তবে জুতা না থাকলে চামড়ার মোজা গিরার নিচ পর্যন্ত কেটে পরতে পারবে। তোমরা এমন কোনো কাপড় পরিধান করো না যাতে ‘জাফরান’ বা ‘ওয়ারছ’ লেগেছে। (মুসলিম, খণ্ড: ০১, হাদিস নং: ৩৭২)
এধরনের যেকোনো কাজ থেকে বিরত থাকার জন্য কোরআন মজিদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘হজ্বের মাসগুলি সুবিদিত। অতএব যে ব্যক্তি এ মাসগুলিতে হজ করা সি'র করে অতঃপর হজে না অশ্লীলতা আছে এবং না অসৎ কাজ এবং না ঝগড়া-বিবাদ। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৯)
কোরআন মজিদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, তোমাদের ওপর প্রাণী শিকার করা হারাম করা হয়েছে, যে পর্যন্ত ইহরাম অবস্থায় থাকো। (সুরা মায়িদাহ, আয়াত: ৯৬)
আতা, তাউস ও মুজাহিদ রাহ. প্রমুখ বিখ্যাত তাবেয়িগণ বলেন, ‘মুহরিম তার বগলের নিচের পশম উপড়ালে বা নখ কাটলে তার উপর ফিদয়া দেওয়া ওয়াজিব হবে। ’ (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং: ১৩৬০৪)
ইয়ালা ইবনে উমাইয়্যা (রা.) থেকে বর্ণিত আছে, রাসুলে (সা.) যখন জিঈররানা নামক স্থানে অবতরণ করলেন, তখন এক ব্যক্তি তার কাছে এলেন, লোকটির পরনে জাফরান মিশ্রিত এক ধরনের সুগন্ধিযুক্ত জুব্বা ছিল...। রাসুল (সা.) তাকে বললেন, সুগন্ধির চিহ্ন দূর করো এবং জুব্বা খুলে ফেল। ’ (মুসলিম, খণ্ড: ১, পৃষ্ঠা: ৩৭৩)
বিখ্যাত তাবেয়ি আতা (রহ.) বলেন, ‘ইহরাম গ্রহণকারী তার শরীরে কিংবা কাপড়ে সুগন্ধিযুক্ত তেল লাগালে তার উপর কাফফারা ওয়াজিব হবে। ’ (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং: ১৪৮৩৩)
ইসলাম শান্তির ধর্ম। ঝগড়া-বিবাদ করা সব সময়ের জন্যি নিষিদ্ধ।ইহরাম অবস্থায় আরো কঠোরভাবে এর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
কোরআন কারিমে আল্লাহ বলেন, ‘হজের মাসগুলি সুবিদিত। অতএব যে ব্যক্তি এ মাসগুলিতে হজ করা স্থির করে, অতঃপর হজে না অশ্লীলতা আছে এবং না অসৎ কাজ এবং না ঝগড়া-বিবাদ। ’ (সুরা বাকারা, আয়াত: ১৯৭)
উকুন, মশা ইত্যাদি না মেরে তাড়িয়ে দেওয়াই বিধান। কাপড় বা শরীরের উকূন মারা নিষিদ্ধ। (আদ্দুররুল মুখতার: ২/৪৮৬-৪৯০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২২৪; মানাসিক ১১৭-১২০; গুনইয়াতুন নাসিক: ৮৫)
তালবিয়া হল সেই দুয়া যা ওমরাহর সময় পড়া হয়। ইহরাম বাঁধা থেকে তাওয়াফ শুরু পর্যন্ত তালবিয়া পাঠের বিধান। তালবিয়া হচ্ছে : ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক। লাব্বাইকা লা শারিকা লাকা লাব্বাইক। ইন্নাল হামদা ওয়ান নি’মাতা লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাক।’
অর্থ : আমি আপনার ডাকে সাড়া দিয়েছি, হে আল্লাহ! আমি আপনার ডাকে সাড়া দিয়েছি। আমি আাপনার ডাকে সাড়া দিয়েছি, আপনার কোন শরীক নেই, আমি আপনার ডাকে সাড়া দিয়েছি। নিশ্চয়ই সমস্ত প্রশংসা, নে’মত এবং সাম্রাজ্য আপনারই। আপনার কোনো শরিক নেই। (বুখারি, হাদিস : ১৫৪৯; মুসলিম, হাদিস : ২৮১১)
পুরূষদের জন্য তালবিয়া পাঠের বিধান হল উচ্চস্বরে। আর নারীরা পাঠ করবেন মৃদুস্বরে। তবে উভয়ের জন্যই তালবিয়া পাঠ অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে।
তাওয়াফ একটি অত্যন্ত বরকতময় এবাদত এবং আল্লাহর কাছে অনুগ্রহ পাওয়ার অন্যতম একটি মাধ্যম।
আল্লাহ কোরআনে বলেন,’অতঃপর তওয়াফের জন্যে দ্রুতগতিতে সেখান থেকে ফিরে আস, যেখান থেকে সবাই ফিরে। আর আল্লাহর কাছেই মাগফেরাত কামনা কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ ক্ষমাকারী, করুনাময়।’ (সূরা বাকারা-১৯৯)।
তাওয়াফ করার জন্য মসজিদুল হারামে ডান পা দিয়ে প্রবেশ করূন এবং এই দোয়া পড়ুন।
‘‘বিসমিল্লাহি ওয়াসসালাতু ওয়াসসালামু ‘আলা রাসূলিল্লাহ, আল্লাহুম্মাফ তাহলী আবওয়াবা রাহমাতিকা’’।
অর্থ: ‘‘আল্লাহর নামে আরম্ভ করছি। সালাত ও সালাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর।
হে আল্লাহ, আপনি আমার জন্য আপনার রহমতের দরজা উন্মুক্ত করে দিন’’।
এরপর তাওয়াফ শুরুর জন্য এগিয়ে যান হাজরে আসওয়াদ এর দিকে। হাজরে আসওয়াদে চুম্বন করুন। যদি চুম্বন করতে না পারেন তাহলে ডান হাত দিয়ে স্পর্শ করে হাতে চুম্বন করুন। আর যদি স্পর্শও করতে না পারেন তাহলে হাত দিয়ে ইশারা করবেন ও তাকবির বলবেন কিন্তু তখন হাতে চুম্বন করবেন না।
এরপর পবিত্র বাইতুল্লাহ কে বাম দিকে রেখে ডান দিকে চলতে থাকুন। যখন হাজরে আসওয়াদ এর পর তৃতীয় কোনা বা রুকুনে ইয়েমেনিতে পৌছাবেন তখন সেই কোনায় চুম্বন করবেন এবং তাকবির পড়া ব্যাতিত স্পর্শ করবেন। যদি স্পর্শ করা সম্ভব না হয় তাহলেও না থেমে তাওয়াফ চালিয়ে যাবেন। তাকবির, তাসবিহ-তাহলিল ইত্যাদি পড়বেন। অত:পর আবার কাবা শরিফ বাম দিকে রেখে রুকুনে শামি ও রুকুনে ইরাকি পার হয়ে রুকুনে ইয়ামেনিতে আসবেন। যদি সম্ভব হয় স্পর্শ করবেন। তা সম্ভব না হলে হাজরে আসওয়াদ এর দিকে অগ্রসর হবেন এবং রুকুনে ইয়ামেনি ও হাজরে আসওয়াদ এর মধ্যবর্তী স্থানে কোরআনে বর্ণিত এ দোয়া পড়বেন।
‘‘রাব্বানা আতিনা ফিদ্দুনিয়া হাসানা, ওয়াফিল আখিরাতি হাসানা, ওয়াকিনা আজাবান্নার।’'’
অর্থ : হে আমার প্রভু! আমাকে দুনিয়াতে কল্যাণ দান কর, আখেরাতেও কল্যাণ দান কর এবং আমাকে জাহান্নাম থেকে বাঁচাও।’’
সূরা বাকারা : ২০১।
তাওয়াফে অন্য সময় তাকবির ও অন্যান্য তাসবীহ-তাহলীল জিকির আসকার পড়বেন।
পুরুষদের তাওয়াফে দুটি বিশেষ কাজ করতে হয়।
১.ইজতেবা : তাওয়াফ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ডান কাঁধ থেকে কাপড় নামিয়ে ডান বগলের নিচ দিয়ে পেঁচিয়ে রাখা। এটিকে ইজতেবা বলা হয়।
২.রমল: রমল মানে স্বাভাবিকের চেয়ে জোরে হাঁটা। তাওয়াফের প্রথম তিন চক্করে স্বাভাবিক হাঁটার গতির চেয়ে সামান্য জোরে হাঁটা পুরুষদের জন্য আবশ্যক। শেষ চার চক্করে রমল করতে হবে না। অর্থাৎ স্বাভাবিক গতিতেই হাঁটা যাবে।
তাওয়াফের সাতটি চক্কর পূর্ণ করুন এবং মাকামে ইব্রাহীমে এসে এই দোয়া পড়ুন।
‘ওয়াত্তাখিযু মিম মাকামি ইবরাহিমা মুসল্লা।’
অতঃপর মাকামে ইবরাহিমের পেছনে দুই রাকাত নামাজ আদায় করবেন। প্রথম রাকাতে সুরা ফাতিহার পর সুরা কাফিরুন এবং দ্বিতীয় রাকাতে সুরা ফাতিহার পর সুরা ইখলাস পড়বেন।
দুই রাকাত সালাত আদায় করার পর জমজম কূপের বরকতময় পানি পান করূন।জমজমের পানি দাঁড়িয়ে পান করুন এবং পান করার সময় বলুন,
‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা ইলমান নাফি’আ, ওয়ারিযক্বাও ওয়াসি’আ, ওয়াশিফাআম মিন কুল্লি দা’ঈ’।
(হে আল্লাহ! আমাকে উপকারী জ্ঞান দান করুন! পর্যাপ্ত রিজিক দান করুন! সব রোগের শিফা দান করুন)।
এর মধ্যদিয়ে তাওয়াফের কাজ শেষ।
নবী ইব্রাহীম (আ) এর স্ত্রী বিবি হাজেরার স্মৃতিবিজড়িত পাহাড় দুটি সাফা ও মারওয়া। সাফা ও মারওয়া পাহাড় দুটি কাবা শরিফের পাশেই অবস্থিত। হজ্জ যাত্রী ও ওমরাহ পালনকারী সকলেই এই দুটি পাহাড়ে সাতবার আসা যাওয়া করতে হয়। এটিকেই সাঈ বলে।কোরআনে রয়েছে, ‘নিশ্চয় সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনাবলির একটি; তাই যারা হজ করবে বা ওমরাহ করবে, তারা এ দুটি প্রদক্ষিণ (সাঈ) করবে।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৫৮)।
সাফা-মারওয়ায় সাঈ করার নিয়ম হলো, জমজমের পানি পান করে ধীরে ধীরে সাফা পাহাড়ে আরোহণ করবেন। সাঈ করার স্থানকে বলা হয় মাসআ। যখন সাফা পাহাড়ের নিকটবর্তী হবেন তখন পড়বেন ‘ইন্নাস সাফা ওয়াল মারওয়াতা মিন শাআ‘ইরিল্লাহ।’
এই আয়াত শুধু সাঈর শুরুতে সাফার নিকটবর্তী হলে পড়তে হয় । সাফা-মারওয়ায় প্রতিবার আয়াতটি পড়বার প্রয়োজন নেই। এরপর পড়বেন ‘নাবদাউ বিমা বাদাআল্লাহু বিহি।’ (অর্থ : আল্লাহ যা দিয়ে শুরু করেছেন আমরাও তা দিয়ে শুরু করছি)।
অতঃপর সাফা পাহাড়ে উঠবেন, যাতে কাবা শরিফ দেখতে পান। কাবার দিকে ফিরে ‘আলহামদু লিল্লাহি আল্লাহু আকবার’ বলবেন। কাবা নজরে এলে কাবাকে সামনে রেখে দুই হাত তুলে দোয়া করবেন।
নবী (সা.)-এর দোয়ার মধ্যে ছিল—‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহু লা শারিকা লাহ। লাহুল মুলকু ওয়া লাহুল হামদু, ওয়া হুয়া আলা কুল্লি শাইয়িন কাদির। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াহদাহ, আনজাযা ওয়াদাহ, ওয়া নাসারা আবদাহ, ওয়া হাযামাল আহযাবা ওয়াহদা।’
এই জিকিরটি তিনবার উচ্চারণ করবেন এবং এর মধ্যে দোয়া করবেন। একবার এই জিকির বলবেন। এরপর দোয়া করবেন। দ্বিতীয়বার জিকিরটি বলবেন এবং এরপর দোয়া করবেন। তৃতীয়বার জিকিরটি বলে মারওয়া পাহাড়ের উদ্দেশে রওনা হয়ে যাবেন। তৃতীয়বারে আর দোয়া করবেন না। যখন সবুজ রং চিহ্নিত স্থানে পৌঁছবেন তখন যত জোরে সম্ভব দৌড়াবেন। কিন্তু কাউকে কষ্ট দেওয়া যাবে না। দ্বিতীয় সবুজ রং চিহ্নিত স্থান থেকে স্বাভাবিক গতিতে হাঁটবেন। এভাবে মারওয়ায় পৌঁছবেন। সবুজ চিহ্নিত স্থানে এই দোয়া পড়বেন : ‘রাব্বিগফির ওয়ারহাম ওয়া আনতাল আ-আযযুল আকরাম।’
সবুজ চিহ্নিত স্থান অতিক্রম করে নারী-পুরুষ সবাই স্বাভাবিক গতিতে হাঁটবেন। মারওয়ার ওপর উঠে কিবলামুখী হয়ে হাত তুলে দোয়া করবেন। সাফা পাহাড়ের ওপর যা যা পড়েছেন ও বলেছেন এখানেও তা তা পড়বেন ও বলবেন। এরপর মারওয়া থেকে নেমে সাফার উদ্দেশে হেঁটে যাবেন। স্বাভাবিকভাবে হাঁটার স্থানে হেঁটে পার হবেন আর দৌড়ানোর স্থানে দৌড়ে পার হবেন। সাফায় পৌঁছার পর আগে যা যা করেছেন তা তা করবেন। মারওয়ার ওপরও আগের মতো তা তা করবেন। এভাবে সাত চক্কর শেষ করবেন। সাফা থেকে মারওয়া গেলে এক চক্কর। মারওয়া থেকে সাফায় এলে এক চক্কর। সাইর মধ্যে যা খুশি জিকির, দোয়া, কোরআন তিলাওয়াত করতে পারবেন।
সাঈ শেষ হলে এই দোয়া পড়বেন,‘রব্বানা তাক্বাব্বাল মিন্না ইন্নাকা আনতাস ছামিউল আলিম।’
এটিকে হলক ও কসর বলা হয়ে থাকে। সাত চক্কর সাঈ শেষ করার পর পুরুষ হলে মাথা মুণ্ডন করবেন অথবা মাথার চুল ছোট করবেন। মুণ্ডন করলে মাথার সর্বাংশের চুল মুণ্ডন করতে হবে। অনুরূপভাবে চুল ছোট করলে মাথার সর্বাংশের চুল ছোট করতে হবে। মাথা মুণ্ডন করা চুল ছোট করার চেয়ে উত্তম। নারীরা আঙুলের এক কর পরিমাণ মাথার চুল কাটবেন। এই আমলগুলোর মাধ্যমে ওমরাহ সমাপ্ত হবে।
ফরজ এবং ওয়াজিব উভয় আমল পরিপূর্ণ ভাবে করার মাধ্যমে হজ্জ ও ওমরাহ সম্পূর্ণরুপে করা বাঞ্চনীয়।
আমর ইবনে দিনার (রহ.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ইবন আব্বাস (রা.) বলেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা হজ ও ওমরাহ পরস্পর পালন (হজ সমাপনের পর ওমরাহ এবং ওমরাহর পর হজ) করবে, কেননা তা (এ দুটি) অভাব, অনটন ও পাপকে দূর করে দেয় যেমন (কামারের) হাপর লোহার মরিচা দূর করে থাকে। (নাসায়ি, হাদিস : ২৬৩০)
এই আলোচনা থেকে আমরা ওমরাহ পালনের নিয়মগুলো বিস্তারিত জানলাম। আশাকরি, ওমরাহ পালন আপনাদের জন্য সহজ হবে ইনশাআল্লাহ। আল্লাহ তাআলা আমাদের সকলকে সঠিক মাসয়ালা জানার ও সেই অনুযায়ী আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
এই পোস্টে আপনার যেকোন মতামত আমাদের কমেন্ট করতে পারেন। অথবা ইমেইল করতে পারেন এই ঠিকানায়।
ওমরাহ একটি সুন্নাত এবাদত।
দম বা ফিদিয়ার মাধ্যমে কাফফারা দিতে হয়।
না ফরজ নয়। সম্ভব হলে গোছল করবেন না হলে ওযু করবেন।
সঠিক পদ্ধতি হল পুরো মাথার চুল মুন্ডানো বা পুরো মাথার চুলই ছোট করা। অনেকে মাথাএ বিভিন্ন অংশ থেকে চুল কেটে ফেলে দিয়ে থাকেন। এটি ঠিক নয়।
যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে গণনা ঠিক রাখার তবে যদি একান্তই কেউ ভুলে যান তাহলে যেটুকু নিয়ে সন্দেহ আছে সেটুকু পুনরায় করতে হবে। উদাহরণ সরুপ যদি ৫ ও ৬ এর মধ্যে সন্দেহ থাকে তাহলে ৫ ধরে এগুতে হবে।
না, ওমরাহ পালন কারিকে বলা হয় মুতামির।