ওমরাহ পালনের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে সভ্যতার সূচনা লগ্নে। যখন আদি পিতা হযরত আদম (আ) দ্বারা বাইতুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর কাবা নির্মিত হয়। এর পর হযরত ইব্রাহিম (আ) ও ইসমাঈল (আ) এটিকে পুনরায় নির্মাণ করেন। মূলত আদম (আ) এর সময়েই বাইতুল্লাহতে হজের আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় যা পরবর্তীতে কালের পরিক্রমায় পুরো দুনিয়ায় পরিচিত লাভ করে।
ইসলাম ধর্মের পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভের মধ্যে হজ অন্যতম। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা) এর জন্য হজ একটি ফরজ এবাদত। হজের মত একটি সুন্নাত এবাদত এই উম্মাহ পালন করে থাকে যেটিকে বলা হয় ওমরাহ। এজন্য ওমরাহকে ছোট হজও বলা হয়। আজ আমরা ওমরাহর ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করব।
ওমরাহ শব্দের অর্থ জিয়ারত করা, পরিদর্শন করা ও সাক্ষাৎ করা। পবিত্র কাবাগৃহের জিয়ারতই মূলত ওমরাহ। ইসলামের ভাষায় পবিত্র হজ্জের সময় ছাড়া অন্য যেকোনো সময় পবিত্র কাবাঘরের তাওয়াফসহ নির্দিষ্ট কিছু কাজ করাকে ওমরাহ বলা হয়।
ওমরাহর ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে বাইতুল্লাহ ও সাফা-মারওয়া কে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে।
আল্লাহ কোরআনে বলেন ‘‘এবং আমরা ইব্রাহীম ও ইসমাঈল-কে আদেশ দিয়েছিলাম যেন তারা আমার ঘরকে তাওয়াফকারীদের, ই‘তিকাফকারীদের, রুকু ও সাজদাহকারীদের জন্য পবিত্র করে রাখে’’। সূরা আল-বাকারা, আয়াত: ১২৫
আল্লাহ কোরআনে আরো বলেন, “আর তোমরা হজ ও ওমরাহ পূর্ণ কর আল্লাহর উদ্দেশ্যে…।” সুরা বাকারা, আয়াত: ১৯৬
আল্লাহর রসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ এক ওমরাহর পর আর এক ওমরাহ উভয়ের মধ্যবর্তী সময়ের (গুনাহের) জন্য কাফফারা। আর জান্নাতই হলো হজ্জে মাবরূরের প্রতিদান। সহিহ বুখারী, হাদিস নং ১৭৭৩
এছাড়াও নবী ইব্রাহীম (আ) এর স্ত্রী বিবি হাজেরা ও তাঁদের সন্তান ইসমাঈল (আ) এর স্মৃতিবিজড়িত দুটি পাহাড় সাফা ও মারওয়া। সাফা ও মারওয়া পাহাড় দুটি কাবা শরিফের পাশেই অবস্থিত। হজ যাত্রী ও ওমরাহ পালনকারী সকলেই এই দুটি পাহাড়ে সাতবার আসা যাওয়া করতে হয়। এটিকেই সাঈ বলে।
কোরআনে রয়েছে, ‘নিশ্চয় সাফা ও মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনাবলির একটি; তাই যারা হজ করবে বা ওমরাহ করবে, তারা এ দুটি প্রদক্ষিণ (সাঈ) করবে।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৫৮)
এভাবেই নবী-রাসুলের স্মৃতি বিজড়িত স্থানে হজ ও ওমরাহর বিধান চালু হয়েছে। তবে ওমরাহর চালু হওয়ার ঘটনাটি ইসলামের ইতিহাসে অসীম গুরুত্ব বহন করে। ওমরাহর ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে ইসলামের শুরুর দিকের একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। যেটিকে আমরা হুদাইবিয়ার সন্ধি নামে জানি।
হিজরতের ষষ্ঠ বছর প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা.) স্বপ্নে দেখেন, তিনি সাহাবিদের নিয়ে ইহরাম বেঁধে ওমরাহর জন্য মক্কায় প্রবেশ করছেন। নবীদের স্বপ্ন মানে ওহী বা আল্লাহর নির্দেশ। এর ফলে সাহাবিরা স্বপ্নের কথা শুনে ওমরাহর জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন এবং সাহাবিদের উৎসাহ-উদ্দীপনা রাসুলুল্লাহ (সা.) উৎসাহিত করে। এরপর তিনি জিলকদ মাসে ওমরাহর জন্য ইহরাম বেঁধে বের হন। তাঁর সঙ্গে স্ত্রী উম্মে সালমা (রা.)-সহ ১ হাজার ৪০০ সাহাবিও ওমরাহর জন্য বের হন। এ সময় তিনি আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম (রা.)-কে মদিনায় প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ করেন।
জুলহুলাইফায় পৌঁছে তিনি ইহরাম বাঁধেন এবং কোরবানির পশুগুলোকে সাজান। কোরবানির জন্য তাঁরা ৭০টি উট সঙ্গে নেন। মুসলিম কাফেলার উদ্দেশ্য ছিল নির্বিঘ্নে ওমরাহ করে চলে আসা। রাসুলুল্লাহ (সা.) ইহরাম বেঁধে মক্কার মুশরিকদের এই বার্তা দিতে চেয়েছিলেন যে তিনি কোনো ধরনের সংঘাত চান না। তারপরও তারা মুসলিম কাফেলাকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিল। ফলে রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের নিয়ে হুদাইবিয়ায় অবস্থান গ্রহণ করেন।
দীর্ঘ আলোচনার পর উভয় পক্ষ এ বিষয়ে একমত হলো যে মুসলিমরা এ বছর ওমরাহ না করে ফিরে যাবে এবং পরের বছর তিন দিনের জন্য মক্কায় প্রবেশের অনুমতি পাবে। চুক্তি অনুযায়ী পরের বছর তথা সপ্তম হিজরির শেষ ভাগে মুসলিমরা আগের বছরের কাজা আদায় করেন। এটাই ছিল হিজরতের পর নবীজি (সা.)-এর প্রথম ওমরাহ। ইতিহাসে এই ওমরাহকে ‘ওমরাতুল কাজা’ নামে উল্লেখ করা হয়। এই সফরে নবীজি (সা.)-এর সঙ্গে দুই হাজার সাহাবি অংশ নেন। তাঁরা আত্মরক্ষার জন্য অস্ত্র সঙ্গে নেন।
তবে কুরাইশ প্রতিনিধি মিকরাজ বিন হাফসের অনুরোধে অস্ত্র মক্কার বাইরে রেখে যান। মুসলিমরা মক্কায় অবস্থানের সময় নিকটবর্তী পাহাড়ের চূড়ায় সরে যান। রাসুলুল্লাহ (সা) জীবনে চারবার ওমরাহ করেছেন বলে বর্ণনা পাওয়া যায়।
কাতাদা (রহ.) থেকে বর্ণিত, আমি আনাস (রা.)-কে জিজ্ঞেস করলাম, আল্লাহর রাসুল (সা.) কতবার ওমরাহ আদায় করেছেন? তিনি বলেন, চারবার। তন্মধ্যে হুদায়বিয়ার ওমরাহ জুলকাদা মাসে যখন মুশরিকরা তাঁকে মক্কায় প্রবেশ করতে বাধা দিয়েছিল।
পরবর্তী বছরের জুলকাদা মাসের ওমরাহ, যখন মুশরিকদের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল, জিরানার ওমরাহ, যেখানে নবী (সা.) গনিমতের মাল, সম্ভবত হুনায়নের যুদ্ধে বণ্টন করেন। আমি বললাম, আল্লাহর রাসুল (সা.) কতবার হজ করেছেন? তিনি বলেন, ‘একবার’। (বুখারি, হাদিস : ১৭৭৮)।
এই পোস্টে আমরা ওমরাহর ইতিহাস বিশদভাবে আলোচনার চেষ্টা করেছি। কোরআন ও হাদিসের আলোকে ওমরাহর ইতিহাস বর্ণনায় এসেছে। আমরা দেখতে পেলাম ইসলামের ইতিহাসের অন্যান্য অধ্যায় গুলোর মতই ওমরাহর ইতিহাসও সমান তাৎপর্য ও গুরুত্ব বহন করে।
আপাত দৃষ্টিতে সে বছর ওমরাহ না করে ফিরে যাওয়াকে ইতিহাসে অনেকে পরাজয় মনে করলেও পরবর্তীতে এর সুফল আমরা খুব স্পষ্টভাবে দেখতে পাই যা রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর অসাধারণ নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় বহন করে।