আমাদের জন্য অনেক সময় হজ এবং ওমরাহর মধ্যে পার্থক্য করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। পার্থক্য করতে গিয়ে আমরা গুলিয়ে ফেলি। হজ ও ওমরাহর মধ্যে বেশ কিছু মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। আমরা এই আর্টিকেলে হজ ও ওমরাহর পার্থক্য গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করার চেষ্টা করব। ইসলামে দুইটি এবাদতই পালনের জন্য নির্দেশ এসেছে।
আল্লাহ কোরআনে বলেন, “আর তোমরা হজ ও ওমরাহ পূর্ণ কর আল্লাহর উদ্দেশ্যে…।” সুরা বাকারা: আয়াত ১৯৬।
আমরা জানি ইসলামের পাঁচটি রুকুন বা খুঁটি রয়েছে। এর মধ্যে একটি হল হজ। হজ অবশ্যই পালন করতে হবে, অর্থাৎ একটি ফরজ এবাদত।
আল্লাহ কোরআনে বলেন, ‘আল্লাহর তরফ থেকে সেই সব মানুষের জন্য হজ ফরজ করে দেওয়া হয়েছে, যারা তা আদায়ের সামর্থ্য রাখে।’ (সুরা আল ইমরান; আয়াত: ৯৭)।
পক্ষান্তরে ওমরাহ একটি সুন্নাত এবাদত। মুসলিমদের জন্য সারা জীবনে হজ যেমন একবার করা ফরজ তেমন ওমরাহও জীবনে একবার করা সুন্নাত।
আল্লাহ কোরআনে আরো বলেন, ‘নিঃসন্দেহে সাফা ও মারওয়া আল্লাহ তা’আলার নিদর্শন গুলোর অন্যতম। সুতরাং যারা কা’বা ঘরে হজ্ব বা ওমরাহ পালন করে, তাদের পক্ষে এ দুটিতে প্রদক্ষিণ করাতে কোন দোষ নেই। বরং কেউ যদি স্বেচ্ছায় কিছু নেকীর কাজ করে, তবে আল্লাহ তা’আলার অবশ্যই তা অবগত হবেন এবং তার সে আমলের সঠিক মুল্য দেবেন।’(সূরা বাকারা-১৫৮)।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) থেকে বর্ণিত-রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহর পথে যুদ্ধে বিজয়ী, হজকারী ও ওমরাহকারী আল্লাহর মেহমান বা প্রতিনিধি। আল্লাহ তাদের আহ্বান করেছেন, তারা তাঁর ডাকে সাড়া দিয়েছেন। আর তারা তাঁর কাছে যা চেয়েছে তিনি তাদের দিয়েছেন’ (ইবনে মাজাহ : ২৮৯৩)।
তবে কেউ যদি স্বামর্থ্যবান হন তাহলে একাধিকবার করতেও কোন বাঁধা নেই। কিন্তু কারো ওপর যদি হজ ফরজ হয় এবং আদায়ের সুযোগ থাকে তাহলে হজ না করে বারবার ওমরাহ করার কোন যুক্তি নেই।
হজ করার জন্য সময় নির্ধারিত করা রয়েছে সেটি হল ৮ জিলহজ থেকে ১২ জিলহজ পর্যন্ত পাঁচ দিন। হজ একটি ফরজ এবাদত এবং এর দিন-তারিখ ইসলামে নির্ধারিত হওয়ার কারণে এটি
পরিবর্তনের কোন সুযোগ নেই। অন্যদিকে ওমরাহ করার জন্য নির্দিষ্ট কোন দিন নেই। হজের দিন গুলো ব্যাতিত যেকোন দিনে ওমরাহ পালন করা যায়। তবে বেশিরভাগ ধর্মপ্রাণ মুসলিমগণ অধিক বরকতের আশায় রমজান মাসে ওমরাহ পালন করে থাকেন।
আরাফার ময়দানে অবস্থান হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা। প্রিয়নবী মুহাম্মদ (সা:) বলেন, ‘‘আল হাজ্জু আরাফাহ’ অর্থাৎ আরাফাই হজ। ঐতিহাসিক আরাফার ময়দানে ৯ জিলহজ সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করাই হলো হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা। হজের আনুষ্ঠানিকতার অংশ হিসেবে ৯ জিলহজ রাত ও ১০ জিলহজ সুবহে সাদিকের পর থেকে সূর্য অস্ত যাওয়ার আগ পর্যন্ত মুজদালিফায় অবস্থান করা ওয়াজিব।
আল্লাহ কোরআনে বলেন, ‘যখন তোমরা আরাফা থেকে প্রত্যাবর্তন করো তখন আল্লাহকে স্মরণ করো (মাশয়ারুল হারামে) মুজদালিফায়। স্মরণ করো যেভাবে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন, তোমরা তো ইতোপূর্বে পথভ্রষ্ট ছিলে।’ সূরা বাকারা: ১৯৮।
ওমরাহ করার ক্ষেত্রে এগুলো করার কোন নিয়ম নেই। ওমরাহর শুধু মক্কা অর্থাৎ মসজিদুল হারামে তাওয়াফ ও সাফা-মারওয়ায় সাঈ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। আরাফার ময়দানে, মুযদালিফায় বা অন্যকোথাও অবস্থানের কোন প্রয়োজনীয়তা নেই।
কুদুম শব্দের অর্থ আগমন করা। বহিরাগত হাজীগণ মক্কায় এসে প্রথম যে তাওয়াফ করেন সেটিকে বলা হয় তাওয়াফে কুদুম। আর বাইতুল্লাহ ত্যাগ করার সময় একটি তাওয়াফ করেন বাইরে থেকে আসা হাজীগণ। ওমরাহ পালনের জন্য এই দুটি তাওয়াফের প্রয়োজন নেই।
হজ পালনের সময় জামরাতুল আক্বাবাহ’তে রামী (কংকর নিক্ষেপ) করার সময় তালবিয়া পড়ার ক্ষেত্রে ছাড় রয়েছে। আবার ওমরাহ পালনে তাওয়াফ শুরু করার সময় তালবিয়া পড়ায় ছাড় রয়েছে।
যদি কোন কারণে হজ নষ্ট হয়, কোন আমল সঠিকভাবে না করা হয় কিংবা তাওয়াফ জানাবাত হালতে (গোছল ফরজ হয় এমন অবস্থায় হয়) তাহলে পরের বছর হজ আবার করতে হবে কোন দম বা কাফফারা দেওয়া যথেষ্ট হবে না।
আরাফায় অবস্থানের পূর্বে স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হলে হজ নষ্ট হয়ে যায়। এক্ষেত্রে গরু বা উট যবেহ করা ছাড়াও পরবর্তী বছর তা কাযা করা জরুরি। (আদ্দুররুল মুখতার: ২/৫৫৮-৫৫৯; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ১/২৪৪; মানাসিক ১১৭)
এক ব্যক্তি হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.)-এর নিকট এসে বললো, আমি ইহরাম অবস্থায় স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়েছি। এখন আমার কী করণীয়? তিনি বললেন, তোমরা উভয়ে হজের অবশিষ্ট আমলগুলো সম্পন্ন করবে। অতঃপর আগামী বছর এ হজ কাজা করবে। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং: ১৩২৪৫)
আলী (রা.) বলেন, স্বামী-স্ত্রী প্রত্যেকের উপর একটি করে গরু বা উট জবাই করা ওয়াজিব। (মুসান্নাফ ইবনে আবি শায়বা, হাদিস নং: ১৩২৫৯)
এক ব্যক্তি আবদুল্লাহ ইবনে উমর (রা.)-কে জিজ্ঞাসা করেন যে, আমি ও আমার স্ত্রী মুহরিম ছিলাম। এ অবস্থায় আমি স্ত্রীর সঙ্গে মিলিত হয়েছি (এখন আমাদের করণীয় কী?) ইবনে উমর (রা.) বলেন, তুমি হজ নষ্ট করে ফেলেছ। তুমি ও তোমার স্ত্রী অন্যান্যদের সঙ্গে থাকবে এবং তাদের মতো হজের (অবশিষ্ট) কাজ করতে থাকবে এবং তারা যখন ইহরাম থেকে মুক্ত হয় তখন তোমরাও মুক্ত হবে। অতঃপর আগামী বছর তুমি ও তোমার স্ত্রী হজ করবে এবং ‘হাদি’ (জবাই করার পশু) নিয়ে আসবে। যদি তোমাদের হাদির সামর্থ্য না থাকে তাহলে হজের মধ্যে তিনটি রোজা রাখবে এবং ফিরে যাওয়ার পর সাতটি রাখেবে। (সুনানে কুবরা লিল-বায়হাকি: ৫/১৬৭)
পক্ষান্তরে ওমরাহ করার সময় এমন কিছু যদি ঘটে যাতে ওমরাহ নষ্ট হওয়ার ভয় থাকে তাহলে দম বা কাফফারা দেওয়াই যথেষ্ট হবে।
আরও পড়ুন: বাংলাদেশ থেকে ওমরাহ পালনের খরচ কত?
ওপরের আলোচনায় আমরা হজ ও ওমরাহর পার্থক্যগুলো সহজ ভাবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। আশা করি হজ ও ওমরাহর পার্থক্য নিয়ে পাঠকের মনে যে প্রশ্ন গুলো ছিল আমরা সেগুলোর যথাসাধ্য উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আপনার যেকোন মতামত জানাতে পারেন কমেন্টের মাধ্যমে। অথবা ইমেইল করতে পারেন এই ঠিকানায়…। মহান আল্লাহ আমাদের সকল কে হজ ও ওমরাহ পার্থক্য গুলো জানার বোঝার ও সে অনুযায়ী আমল করার তৌফিক দান করুন।